★★কেন মোটা হয় মানুষ?
অতিরিক্ত খাবার তো অবশ্যই প্রধান সমস্যা। এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ডা. দেবমাল্য সান্যাল বলছেন, ‘‘আপনি যদি সৃষ্টির
একেবারে গোড়ার দিকের কথা চিন্তা করেন, তা হলে দেখবেন, মানুষের জীবনে কখনওই খাবারের প্রাচুর্য ছিল না। আদতে আমরা ছিলাম শিকারি, আর ফল-মূল সংগ্রহ করতাম।’’ তার অনেক পর চাষবাস শুরু হয়। শিকার সর্বক্ষণ হাতের কাছে থাকবে না, মাইলের পর মাইল ঘুরেও কিছুই না পাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। চাষবাসও সব বছর সমান হয় না। অর্থাৎ খাদ্য জোটানোর জন্য আমাদের প্রচুর পরিশ্রম করার কথা, তার পরেও যে রোজ পাওয়া যাবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই। তাই খাবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলেই শরীর সেটাকে মেদ হিসেবে জমিয়ে রাখবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনও অভাবে পড়তে না হয়।
তার উপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO-র সমীক্ষায় প্রকাশ, ওজন বাড়ার ক্ষেত্রে নাকি এশিয়ার মানুষ অন্যদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে আছে। কিছু বিজ্ঞানী বলেন, মাতৃগর্ভে যে সব শিশু অপুষ্টির শিকার হয়, তাদের শরীরে ফ্যাট জমিয়ে রাখার একটা প্রবণতা তৈরি হয়ে যায়। এখন হয়তো পরিস্থিতি খানিকটা উন্নত হয়েছে, কিন্তু বছরকয়েক আগেও এই মহাদেশের বহু গর্ভবতী অপুষ্টিতে ভুগতেন এবং এঁদের সন্তানদের ওবেসিটি হওয়ার আশঙ্কাও বেশি থাকত। আর একদল গবেষকের ধারণা, যেহেতু এশিয়ার বাসিন্দারা হাজার হাজার বছর প্রায়-দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থেকেছে, তাই আমাদের শরীর খাবারের প্রাচুর্য একেবারেই নিতে পারে না। ‘‘এক তো এই থ্রিফটি জিনের কল্যাণে অ্যাবডমিনাল অ্যাডিপোসিটির আশঙ্কা, তার উপর আছে আধুনিক জীবনের স্ট্রেস, কম পরিশ্রমের মতো সমস্যাগুলো। আমাদের মা-ঠাকুমারা ছোট থেকেই স্নেহ দেখাতে গিয়ে ঠেসে খাবার খাওয়ান, বাচ্চাদের খেলাধুলো নয়, লেখাপড়ায় বেশি উৎসাহ দেওয়া হয়। এখন আবার যোগ হয়েছে আধুনিক জীবনযাত্রার নানা সুবিধের দিক। ফলে পরিস্থিতি বেশ জটিল,’’ মেনে নিচ্ছেন হেনা।
শহরাঞ্চলে বসবাসকারী অধিকাংশ পরিবারেই আয় এখন ঊর্ধ্বমুখি, খরচের জন্য বাড়তি টাকা থাকছে প্রায় প্রত্যেকের হাতে। তাই বেশি খাওয়া, বিশেষত বাজার থেকে কেনা যে সব খাবারে প্রচুর পরিমাণে নুন, চিনি, ফ্যাট রয়েছে, তেমন খাবার খাওয়া আমাদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। নিম্নবিত্ত পরিবারেও দশ-বারো টাকার ইনস্ট্যান্ট ন্যুডল, চকোলেট বা কেক-চিপসের প্যাকেট কেনাটা সমস্যা নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা ঢুকে পড়ছে বাচ্চার দৈনিক খাদ্যতালিকায়৷
কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেদবাহুল্যের সমস্যা পারিবারিক সূত্রেও আসে। ঠিক যেভাবে মা বা বাবার চোখের তারা বা ত্বকের রং উত্তরাধিকার সূত্রে পায় সন্তান, তেমনভাবেই আসে বাড়তি ওজনের সমস্যাও। কিছু জিন শরীরকে বলে দেয় ঠিক কীভাবে খাবারের মেটাবলিজ়ম হবে, বা শরীর জমিয়ে রাখা খাবার বা ফ্যাট কীভাবে ব্যবহার করবে। এর খানিকটা পারিবারিক ডিএনএ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। যাঁদের পরিবারে ওবেসিটির সমস্যা আছে, তাঁদের শরীরে ফ্যাট বার্ন করার পদ্ধতিটা ধীর গতির হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওজন বাড়াটা যত তাড়াতাড়ি হয়, কমাতে গেলে তার চেয়ে অনেকটাই বেশি সময় লাগে।
নেফ্রোলজিস্ট ডা. শৈবাল রক্ষিত আরও কয়েকটি সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করছেন। ‘‘আজকালকার মেয়েরা কেরিয়ারের ব্যাপারে খুব সচেতন। অনেকেই তিরিশের পরে মা হন এবং গর্ভাধান পিছিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়মিত কনট্রাসেপ্টিভ পিল গ্রহণ করেন। পিলের কারণেও ওজন বাড়তে পারে। হরমোনের সমস্যা, হাইপোথাইরয়েডিজ়ম বা কুশিং সিনড্রোম থাকলে বা দীর্ঘদিন স্টেরয়েড খেলেও বাড়তি ওজনের সমস্যা হয়। জেনেটিক অথবা কনজেনিটাল কিছু সমস্যাও ওজন বাড়ার জন্য দায়ী হয় ক্ষেত্রবিশেষে। এমনকী হাইপোথ্যালামাসে কোনও আঘাত বা টিউমার থাকলেও রোগী বাড়তি ওজনের সমস্যায় ভুগতে পারেন। দীর্ঘদিন যাঁরা অ্যান্টি সাইকোটিক বা অ্যান্টি এপিলেপটিক ওষুধ খাচ্ছেন বা সুগারের ওষুধ নিচ্ছেন, তাঁদেরও ওজন নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তাই আমার পরামর্শ, বাড়তি ওজনের সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁরা অতি অবশ্যই একবার ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। তিনিই বলে দেবেন ঠিক কী কারণে আপনার ওজন বাড়ছে এবং কোন পথে এগিয়ে গেলে সেই বাড়তি ওজনটা কমানো যায়।’’
No comments:
Post a Comment